আমরা রাষ্ট্রে বাস করি। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কিছু নিয়ম কানুন রয়েছে। এসব নিয়মাবলির সমষ্টিকে সংবিধান বলে । সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় । সংবিধানকে বলা হয় রাষ্ট্রের দর্পণ বা আয়নাস্বরূপ । সংবিধানে নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য, শাসকের ক্ষমতা এবং নাগরিক ও শাসকের সম্পর্ক কিরূপ হবে তা সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকে । কাজেই রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সংবিধান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন । এ অধ্যায়ে আমরা সংবিধানের ধারণা, সংবিধানের গুরুত্ব, সংবিধান প্রণয়ন পদ্ধতি, বিভিন্ন প্রকার সংবিধানের বৈশিষ্ট্য, বাংলাদেশের সংবিধান তৈরির ইতিহাস, এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এবং বিভিন্ন সংশোধনী সম্বন্ধে জানব ।
এ অধ্যায় পড়া শেষে আমরা-
সংবিধান হলো রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক দলিল। যে সব নিয়মের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় তাকে সংবিধান বলে । সরকার কীভাবে নির্বাচিত হবে, আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ কীভাবে গঠিত হবে, এদের ক্ষমতা কী হবে, জনগণ ও সরকারের সম্পর্ক কেমন হবে-এসব বিষয় সংবিধানে উল্লেখ থাকে । এসব বিষয়ে সংবিধানের পরিপন্থী কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না। তাই সংবিধানকে রাষ্ট্রের চালিকা শক্তি বলা হয় । রাষ্ট্র বিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল বলেন, ‘সংবিধান হলো এমন এক জীবন পদ্ধতি যা রাষ্ট্র স্বয়ং বেছে নিয়েছে ।'
সংবিধান প্রণয়নের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে । তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য পদ্ধতিগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলো-
১. অনুমোদনের মাধ্যমে: জনগণকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে অতীতে প্রায় সব রাষ্ট্রেই স্বেচ্ছাচারী শাসক নিজের ইচ্ছানুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করত। এতে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দেয় । জনগণকে শান্ত করার জন্য এবং তাদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য একপর্যায়ে শাসক সংবিধান প্রণয়ন করেন। যেমন- ১২১৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজা জন ‘ম্যাগনাকার্টা' নামে অধিকার সনদ স্বাক্ষরে বাধ্য হন । এটি ব্রিটিশ সংবিধানের এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে ।
২. আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে: সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠিত গণপরিষদের সদস্যদের আলাপ- আলোচনার মাধ্যমে সংবিধান রচিত হতে পারে। ভারত, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান এভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে । বাংলাদেশের সংবিধানও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গণপরিষদ কর্তৃক ১৯৭২ সালে প্রণীত হয় ।
৩. বিপ্লবের দ্বারা: শাসক যখন জনগণের স্বার্থ ও কল্যাণ নিহিত নয় এমন কাজ করে অর্থাৎ শাসক স্বৈরাচারী শাসকে পরিণত হয়, তখন বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শাসকের পরিবর্তন ঘটে। নতুন শাসকগোষ্ঠী শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করে নতুন সংবিধান তৈরি করে। রাশিয়া, কিউবা, চিনের সংবিধান এ পদ্ধতিতে তৈরি হয়েছে ।
৪. ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে: বিবর্তনের মাধ্যমে সংবিধান গড়ে উঠতে পারে। যেমন- ব্রিটেনের সংবিধান ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে লোকাচার ও প্রথার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে সংবিধান কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রণয়ন করা হয় না, ধীরে ধীরে গড়ে উঠে। তাই বলা হয়, ব্রিটিশ সংবিধান তৈরি হয়নি, গড়ে উঠেছে।
সংবিধানের শ্রেণিবিভাগ নিচে দেখানো হলো-
১. লেখার ভিত্তিতে সংবিধানের শ্রেণিবিভাগ : লেখার ভিত্তিতে সংবিধান দুই ধরনের হতে পারে । যথা : ক. লিখিত সংবিধান ও খ. অলিখিত সংবিধান ।
ক. লিখিত সংবিধান : লিখিত সংবিধানের অধিকাংশ বিষয় দলিলে লিপিবদ্ধ থাকে । বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান লিখিত ।
খ. অলিখিত সংবিধান : অলিখিত সংবিধানের অধিকাংশ নিয়ম কোনো দলিলে লিপিবদ্ধ থাকে না। এ ধরনের সংবিধান প্রথা ও রীতিনীতিভিত্তিক । চিরাচরিত নিয়ম ও আচার অনুষ্ঠানের ভিত্তিতে এ ধরনের সংবিধান গড়ে উঠে । যেমন- ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত ।
তবে এ কথা সত্য যে, কোনো সংবিধানই পুরোপুরি লিখিত বা অলিখিত নয় । কোনোটি বেশি লিখিত আবার কোনোটি কম লিখিত ।
২. সংশোধনের ভিত্তিতে সংবিধানের শ্রেণিবিভাগ: সংশোধনের ভিত্তিতে সংবিধান দুই প্রকার । যথা ক. সুপরিবর্তনীয় সংবিধান ও খ. দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান ।
ক. সুপরিবর্তনীয় সংবিধান : সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের যে কোনো ধারা সহজে পরিবর্তন বা সংশোধন করা যায় । এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন বা পরিবর্তন করতে কোনো জটিলতার প্রয়োজন হয় না । সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আইনসভা এর যেকোনো অংশ সংশোধন করতে পারে। ব্রিটিশ সংবিধান সুপরিবর্তনীয় সংবিধান ।
খ. দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান : দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের কোনো ধারা সহজে পরিবর্তন বা সংশোধন করা যায় না, এ ক্ষেত্রে সংবিধান পরিবর্তন বা সংশোধন করতে হলে জটিল পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হয়। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় এ ধরনের সংবিধান পরিবর্তন করা যায় না। প্রয়োজন হয় বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, সম্মেলন ও ভোটাভুটির । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় ।
লিখিত সংবিধানের যেসব উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সেগুলো নিম্নে বর্ণিত হলো-
১. সুস্পষ্টতা : লিখিত সংবিধানের অধিকাংশ ধারা লিখিত থাকে বলে এটি জনগণের নিকট সুস্পষ্ট ও বোধমগ্য হয় । লিখিত সংবিধানে সাধারণত সংশোধন পদ্ধতি উল্লেখ থাকে বিধায় খুব সহজে পরিবর্তন বা সংশোধন করা যায় না। কিন্তু সমাজ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। লিখিত সংবিধান পরিবর্তিত সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। এজন্য এটি কখনো কখনো প্রগতির অন্তরায় হিসেবে কাজ করে । তাছাড়া অনেক সময় সংবিধান সংশোধনের জন্য জনগণ বিপ্লব করতে বাধ্য হয়।
২. স্থিতিশীলতা : এ সংবিধানে সব কিছু লিখিত থাকে বিধায় শাসক তার ইচ্ছামতো এটি পরিবর্তন বা সংশোধন করতে পারে না । তাই লিখিত সংবিধান যেকোনো পরিস্থিতিতে স্থিতিশীল থাকতে পারে । লিখিত সংবিধানের সকল ধারা জনগণ ও শাসক মেনে চলতে বাধ্য হয় ।
৩. যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থার উপযোগী : লিখিত সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থার জন্য উপযোগী । এ সংবিধানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করে দেওয়া হয়। সংবিধান লিখিত না হলে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় এরূপ ক্ষমতা বণ্টন সম্ভব হতো না । যেমন- ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে লিখিত সংবিধানের মাধ্যমে ক্ষমতা বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে । উল্লেখ্য, লিখিত সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সফলতার পূর্বশর্ত ।
8. শাসক ও জনগণের সম্পর্ক : লিখিত সংবিধানে শাসকের ক্ষমতা কী হবে, জনগণ কী কী অধিকার ভোগ করবে তার উল্লেখ থাকে । এর ফলে শাসক ও জনগণ নিজেদের ক্ষমতা ও অধিকার সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারে।
অলিখিত সংবিধানের বৈশিষ্ট্য নিম্নে বর্ণনা করা হলো-
১. প্রগতির সহায়ক : সমাজ সর্বদা প্রগতির দিকে ধাবিত হয়। আর অলিখিত সংবিধান সমাজের প্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে সহজে পরিবর্তন করা যায়। অর্থাৎ এটি সমাজের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সহজেই খাপ খাওয়াতে পারে। সুতরাং অলিখিত সংবিধান প্রগতির সহায়ক। কিন্তু অধিক পরিবর্তনশীলতা আবার অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে ।
২. জরুরি প্রয়োজনে সহায়ক : অলিখিত সংবিধান যেহেতু সহজে পরিবর্তনীয়, তাই জরুরি প্রয়োজন মিটাতে অলিখিত সংবিধান অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে । তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অলিখিত সংবিধান ঘন ঘন পরিবর্তনের ফলে কোনো স্থায়ী নীতি ও কার্যক্রম হাতে নেওয়া যায় না। এর ফলে সরকারব্যবস্থা অস্থিতিশীল হতে পারে ।
৩. বিপ্লবের সম্ভাবনা কম : এ সংবিধান সহজে পরিবর্তন করা যায় । জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী অলিখিত সংবিধান পরিবর্তন হতে পারে বিধায় বিপ্লবের সম্ভাবনা কম থাকে ।
৪. বিবিধ : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় অলিখিত সংবিধান উপযোগী নয়। এ সংবিধানের অধিকাংশ বিষয় লিখিত না থাকায় রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয় সম্পর্কে অনেকেরই সুস্পষ্ট ধারণা থাকে না ।
উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য:
বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের কোনো না কোনো সংবিধান রয়েছে। যে রাষ্ট্রের সংবিধান যত উন্নত, সে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা ততটা উত্তমভাবে পরিচালিত হয় । উত্তম সংবিধানের নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো রয়েছে ।
১ . সুস্পষ্ট : উত্তম সংবিধানে অধিকাংশ বিষয় লিখিত থাকে । এ সংবিধানের ভাষা সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল হয়। এ কারণে উত্তম সংবিধান সকলের নিকট সুস্পষ্ট ও বোধগম্য হয় ।
২. সংক্ষিপ্ত : উত্তম সংবিধান সংক্ষিপ্ত প্রকৃতির । অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক বিষয় উত্তম সংবিধানে স্থান পায় না। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য উল্লেখযোগ্য বিধিবিধানগুলো এ সংবিধানে উল্লেখ থাকে ।
৩. মৌলিক অধিকার : নাগরিকের মৌলিক অধিকার উত্তম সংবিধানে উল্লেখ থাকে। এর ফলে জনগণ তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয় । তাছাড়া শাসক বা অন্য কেউ এ অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না ।
৪. জনমতের প্রতিফলন : উত্তম সংবিধান জনমতের ভিত্তিতে প্রণীত হয় । এ সংবিধানে জনগণের চাহিদা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে । তাছাড়া সামাজিক রীতি-নীতি ও ঐতিহ্য এ সংবিধানে প্রতিফলিত হয় ।
৫. সুষম প্রকৃতির : উত্তম সংবিধান সুষম প্রকৃতির। এর অর্থ, উত্তম সংবিধান সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের মাঝামাঝি অবস্থান করে । অর্থাৎ এটি খুব সুপরিবর্তনীয় কিংবা খুব বেশি দুষ্পরিবর্তনীয় নয়। এর ফলে উত্তম সংবিধান সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম।
৬. সংশোধন পদ্ধতি : উত্তম সংবিধানের কোনো ধারার সংশোধন বা পরিবর্তন নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হয় । অর্থাৎ এ সংবিধানে সংশোধন পদ্ধতি উল্লেখ থাকে। সংবিধানের কোন অংশ কীভাবে সংশোধন করা হবে তা উত্তম সংবিধানে উল্লেখ থাকে ।
৭. রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি: রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি উত্তম সংবিধানে উল্লেখ থাকে । যেমন- বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সন্নিবেশিত করা হয়েছে ।
৮. জনকল্যাণকামী : দার্শনিক রুশো বলেছেন, যে আইনে মানুষের কল্যাণ নাই তা উত্তম সংবিধান হতে পারে না ।
সুতরাং উত্তম সংবিধান হবে জনকল্যাণকামী । কোনো সংবিধানে উপরে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো থাকলে তাকে উত্তম সংবিধান বলা যাবে ।
বাংলাদেশের সংবিধান:
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের জন্য ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়। উক্ত কমিটির সভাপতি ছিলেন ড. কামাল হোসেন। এ কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ১৭ই এপ্রিল। এ কমিটি অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাংলাদেশের সংবিধানের খসড়া তৈরি করে এবং তা ১৯শে অক্টোবর ১৯৭২ গণপরিষদে উত্থাপিত হয়। এরপর সংবিধানের বিভিন্ন দিক নিয়ে গণপরিষদে আলোচনার পর ৪ঠা নভেম্বর ১৯৭২ সালে সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য:
বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে বর্ণনা করা হলো-
১. লিখিত দলিল : বাংলাদেশের সংবিধান একটি লিখিত দলিল। এর ১৫৩টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এটি ১১টি ভাগে বিভক্ত । এর একটি প্রস্তাবনাসহ সাতটি তফসিল রয়েছে।
২. দুষ্পরিবর্তনীয় : বাংলাদেশের সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয়। কারণ, এর কোনো বিধান সংযোজন, পরিবর্তন বা সংশোধন করতে জাতীয় সংসদের মোট সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতির প্রয়োজন হয় ।
৩. রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি : জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নির্ধারণ করা হয়েছে । রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এসব মূলনীতির দ্বারা অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত হয়ে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে ।
8. মৌলিক অধিকার : সংবিধান হলো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কী কী অধিকার ভোগ করতে পারব তা সংবিধানে উল্লেখ থাকায় এগুলোর গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে । যেমন- জীবনধারণের অধিকার, চলাফেরার অধিকার, বাকস্বাধীনতার অধিকার, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, ধর্মচর্চার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি ।
৫. সর্বজনীন ভোটাধিকার: বাংলাদেশের সংবিধানে সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রদান করা হয়েছে । অর্থাৎ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, পেশা ইত্যাদি নির্বিশেষে ১৮ বা তদুর্ধ বছর বয়সের এ দেশের সকল নাগরিক ভোটাধিকার লাভ করেছে ।
৬. প্রজাতান্ত্রিক : সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র । এখানে সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ । জনগণের পক্ষে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন ।
৭. সংসদীয় সরকার : বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় । প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার হাতে শাসনকার্য পরিচালনার ভার অর্পণ করা হয়। এ সরকারব্যবস্থায় মন্ত্রিপরিষদ তার কাজের জন্য আইনসভার নিকট দায়ী থাকে ।
৮. এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র : বাংলাদেশ একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র । এখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মতো কোনো অঙ্গরাজ্য বা প্রাদেশিক সরকার নেই । জাতীয় পর্যায়ে একটিমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা সমগ্র দেশ পরিচালিত হয় ।
৯. আইনসভা : বাংলাদেশের আইনসভা এক কক্ষবিশিষ্ট। এর নাম 'জাতীয় সংসদ'। প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা জাতীয় সংসদের উপর ন্যাস্ত। বর্তমানে জাতীয় সংসদ ৩৫০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত। সংসদের মেয়াদ ৫ বছর।
১০. সর্বোচ্চ আইন : বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। কারণ বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে দেশের প্রচলিত কোনো আইনের সংঘাত সৃষ্টি হলে সে ক্ষেত্রে সংবিধান প্রাধান্য পাবে । অর্থাৎ যদি কোনো আইন সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যহীন হয়, তাহলে ঐ আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততোখানি বাতিল হয়ে যাবে ।
১১. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা : বাংলাদেশের সংবিধানে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের বিধান রয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধনীসমূহ ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের পর থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সংবিধান মোট ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে । বাংলাদেশ সংবিধানের ১৭টি সংশোধনীর প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য নিম্নে বর্ণিত হলো-
সংশোধনী ও সাল
|
বিষয়বস্তু |
---|---|
প্রথম সংশোধনী জুলাই, ১৯৭৩ |
• সংসদীয় সরকারব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। চতুর্থ সংশোধনী • ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিধান করা হয়। |
দ্বিতীয় সংশোধনী সেপ্টেম্বর,১৯৭৩ |
• দেশের ভেতরে গোলযোগ, যুদ্ধের আশঙ্কা কিংবা মানুষের জীবনযাত্রায় সংকট দেখা দিলে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে ‘জরুরি অবস্থা' ঘোষণার ক্ষমতা দেওয়া হয়। |
তৃতীয় সংশোধনী নভেম্বর, ১৯৭৪ |
• বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে ভারত- বাংলাদেশের সীমান্ত সংক্রান্ত যে চুক্তি হয়, তৃতীয় সংশোধনীতে তা বৈধ ঘোষণা করা হয় । |
চতুর্থ সংশোধনী | জানুয়ারি, ১৯৭৫ |
• উপরাষ্ট্রপতির পদ সৃষ্টি এবং সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে একটিমাত্র জাতীয় দল সৃষ্টি করা হয়। |
পঞ্চম সংশোধনী এপ্রিল, ১৯৭৯ |
• ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে সামরিক সরকার কর্তৃক যেসব বিধিবিধান প্রণয়ন ও সংবিধানের সংশোধনী আনা হয়েছে, সেগুলো পঞ্চম সংশোধনী আইনে বৈধ বলে ঘোষণা করা হয় । • রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পরিবর্তন করা হয় । • বাংলাদেশের নাগরিকতা 'বাঙালি' থেকে 'বাংলাদেশি' করা হয়। |
ষষ্ঠ সংশোধনী |
• উপরাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক নয় এই বিধান করে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। |
সপ্তম সংশোধনী নভেম্বর, ১৯৮৬ |
• ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত জেনারেল এরশাদ যেসব বিধি-বিধান ও সামরিক আইন জারি এবং তার ভিত্তিতে যেসব কাজ সম্পাদন করেছিলেন, সেগুলোকে এ সংশোধনীতে বৈধতা দেওয়া হয় । |
অষ্টম সংশোধনী জুন, ১৯৮৮ |
• বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং ঢাকার বাইরে হাইকোর্টের ৬টি বেঞ্চ স্থাপন করা হয় । |
নবম সংশোধনী জুলাই, ১৯৮৯ |
• জনগণের সরাসরি ভোটে উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান করা হয় । • রাষ্ট্রপতি পদে কোনো ব্যক্তি পর পর দুই মেয়াদের অধিক অধিষ্ঠিত না হতে পারার নিয়ম করা হয়। |
দশম সংশোধনী জুন, ১৯৯০ |
• জাতীয় সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৩০টি আসনের সময় আরও ১০ বছর বৃদ্ধি করা হয় । |
একাদশ সংশোধনী আগস্ট, ১৯৯১ |
• অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ কর্তৃক প্ৰয়োগকৃত সকল কার্যক্রম বৈধ করা হয় এবং পুনরায় তাঁর প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে যাবার বিধান করা হয় । |
দ্বাদশ সংশোধনী সেপ্টেম্বর, ১৯৯১ |
• রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থার পরিবর্তে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন হয়। • উপরাষ্ট্রপতির পদ বিলুপ্ত করা হয়। |
ত্রয়োদশ সংশোধনী মার্চ, ১৯৯৬ |
• অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। |
চতুর্দশ সংশোধনী মে, ২০০৪ |
• মহিলাদের জন্য জাতীয় সংসদে ৪৫টি আসন সংরক্ষণ করা হয়। • রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিকৃতি সরকারি অফিসসহ নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের বিধান করা হয় । • সুপ্রীমকোর্টের বিচারক, পিএসসির চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হয়। |
পঞ্চদশ সংশোধনী জুলাই,২০১১ |
• তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। • ১৯৭২ মূল সংবিধানের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি যথাঃ জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করা হয় । • রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখার পাশাপাশি সকল ধর্মচর্চার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয় । • জাতীয় সংসদে মহিলাদের জন্য ৫০টি আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। |
ষোড়শ সংশোধনী সেপ্টেম্বর,২০১৪ |
• সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনার বিধান পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। |
সপ্তদশ সংশোধনী জুলাই, ২০১৮ | •জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত ৫০ টি নারী আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা আরো ২৫ বছর রাখার বিধান করা হয়। |